রানা প্লাজা ধসের পাঁচ দিন পর জীবিত উদ্ধার হন সুনীতা। হাসপাতালে পাঁচ দিন পর জ্ঞান ফিরেছিল তাঁর। অর্থাভাবে চিকিৎসা করাতে পারছেন না। পুরোপুরি সুস্থ না হওয়ায় কাজও করতে পারছেন না।
সরকারের কাছ থেকে কোনো টাকাই পাননি সুনীতা। বিকাশের মাধ্যমে ৩০ হাজার টাকা আর হাসপাতালে থাকাকালীন ২৭ হাজার টাকা পান তিনি। এর মধ্যে বিকাশের মাধ্যমে পান ক্রেতা প্রতিষ্ঠান প্রাইমার্কের দেওয়া অর্থ।
সুনীতা নিজের অসহায়ত্বের কথা বলেন এভাবে, ‘আমার ডান হাতের হাড় ভাঙা। তাতে রড ঢোকানো। মাথা ফেটে গিয়েছিল। পায়ে মেশিন পড়েছিল। সেই ব্যথা এখনো সারে নাই।’ তিনি আরও বলেন, ‘স্বামী দিনমজুরি করে। আমি কাজ করতে পারি না। অনেক কষ্টে সংসার চলে।’
ব্র্যাক সেন্টারে গতকাল রোববার ‘রানা প্লাজা দুর্ঘটনা ও পরবর্তী পদক্ষেপসমূহ: প্রতিশ্রুতি ও বাস্তবায়নের সর্বশেষ পরিস্থিতি’ শীর্ষক আলোচনা সভায় এসেছিলেন সুনীতা। গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এই সভার আয়োজন করে।
আরও এসেছিলেন মুকুল বেগম। রানা প্লাজা ধসে নিউ ওয়েভ বটমের শ্রমিক মোজ্জামেল হোসেন মারা যান। তাঁরই স্ত্রী মুকুল বেগম এক মেয়ে নিয়ে কোনো রকমে বেঁচে আছেন। তিনি বললেন, ‘২৪ তারিখ সকালে ভাত খাইয়া সেই যে গেল আমার স্বামী। আর ফিরে আইল না…।’
বলতে বলতে ঝরঝরিয়ে কেঁদে ফেলেন মুকুল বেগম। কাঁদতে কাঁদতে বলেন, সেদিন থেকে আমার ঘরে কোনো আলো জ্বলে না। আমার একটি মেয়ে আছে। স্বামীর স্বপ্ন ছিল মেয়েকে শিক্ষিত বানাবে। কিন্তু আমি এখন তাকে কীভাবে পড়াশোনা করাব। দিন যায় পাহাড়ের মতো।’
মুকুল বেগম বলেন, ‘আমার স্বামী বেতন পেলেই মেয়ের জন্য ফলমূল নিয়ে আসতেন। কিন্তু এখন একটি কলাও কিনে দিতে পারি না মেয়েকে।’ মুকুল বেগমও দাফনের জন্য ২০ হাজার টাকা আর বিকাশের মাধ্যমে নির্ধারিত অর্থ ছাড়া কিছুই পাননি।
মুকুল বেগমের কান্না ছুঁয়ে যায় সবাইকে। শ্রমসচিব মিকাইল শিপার মুকুলের নাম টুকে নেন, আর্থিক সহায়তার আশ্বাস দেন। একই সঙ্গে উপস্থিত সাংসদ ও বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি টিপু মুন্সী মুকুল বেগমের মেয়েকে পড়াশোনা বাবদ প্রতি মাসে পাঁচ হাজার টাকা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।
হবিগঞ্জ থেকে এসেছিলেন রথীন্দ্রনাথ দাশ। তাঁর মেয়ে নির্মলা রানী দাশ এখনো নিখোঁজ। কাজ করতেন রানা প্লাজার নিউ ওয়েব বটম কারখানায়। দুর্ঘটনার পর লাশ পাওয়া যায়নি। এখন পর্যন্ত কোনো আর্থিক সহায়তাও পায়নি এই হতভাগা শ্রমিকের পরিবারটি।
রথীন্দ্রনাথ দাশনির্মলার বাবা রথীন্দ্রনাথ বলেন, ‘মেয়ের মজুরি দিয়েই সংসার চলত। আমার বয়স হয়ে গেছে। কাজ করতে পারি না। খুব কষ্টে সংসার চলছে।’ তিনি জানান, শুধু বিকাশের মাধ্যমে টাকা পেয়েছেন। সরকারের পক্ষ থেকে কিছু পাননি। যদিও ডিএনএ পরীক্ষার জন্য নমুনা দিয়েছিলেন।
মরিয়ম বেগম ডান হাত হারান। দীর্ঘ চিকিৎসা করেও পুরোপুরি সুস্থ হননি। কৃত্রিম হাত লাগিয়েও ঘরের কাজ পর্যন্ত করতে পারেন না।
মরিয়ম বেগম বলেন, ‘আমি এখন কিছুই করতে পারি না। বাম না, ডান হাতটা থাকলে তো কিছু করতে পারতাম। কৃত্রিম হাত দিয়েছে। কিন্তু এত ভারী যে, পরলেই যন্ত্রণা হয়। তাই খুলে রাখি। আমার কাছে এটার কোনো মূল্য নাই। তিনি বলেন, ‘এমনিতে হয়তো দুই দিন বাঁচতাম। কিন্তু কৃত্রিম হাতটি পরলে মনে হয়, সেটিও আর পারব না।’ কৃত্রিম হাত নিয়ে সমস্যায় থাকা এই মরিয়ম অবশ্য সরকারের কাছ থেকে ১২ লাখ টাকা পেয়েছেন। মানুষের কাছ থেকেও পেয়েছেন কিছু সহায়তা।
এই মরিয়মের ডান হাত কেটে উদ্ধার করেছিলেন উদ্ধারকর্মী খোঁয়াজ আলী। বাড়ি মানিকগঞ্জ। কাজের জন্য অনেক দিন ধরেই সাভার থাকেন। বললেন, ‘২৪ এপ্রিল ঘটনার ১০-১৫ মিনিটের মধ্যেই আমি ঘটনাস্থলে যাই। উদ্ধারকাজ শুরু করি।’
খোঁয়াজ আলী বলেন, ‘উদ্ধারকর্মী অনেকেই এখন পর্যন্ত অসুস্থ। আমি নিজেও অসুস্থ। এখনো স্বাভাবিক জীবনে আসতে পারি নাই। ৮৫ শতাংশ উদ্ধারকর্মী শ্রমিক হওয়ায় অর্থাভাবে চিকিৎসা করাতে পারছেন না।’ তিনি আরও বলেন, এখন পর্যন্ত কারও কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা পাননি উদ্ধারকর্মীরা। শুরুতে কিছু খরচ পেলেও বর্তমানে চিকিৎসার জন্য কেউ এগিয়ে আসছেন না।
মুকুল বেগমঅনুষ্ঠানে মূল প্রতিবেদন উপস্থাপন করে সিপিডির অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম জানান, নিখোঁজ শ্রমিকদের পরিবারই সবচেয়ে খারাপ অবস্থার মধ্যে আছে। পরিচয় নিশ্চিত না হওয়ায় তাঁরা কোনো আর্থিক সহায়তা পাননি। অন্যদিকে আহত শ্রমিকদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা যায়নি। দুই হাজার ৪৩৮ জন আহত শ্রমিকের মধ্যে মাত্র ৭১ জন আবার কাজে যোগ দিয়েছেন।
অথচ গত ১৪ জুলাই সংসদে প্রশ্ন-উত্তর পর্বে কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী জানিয়েছিলেন, রানা প্লাজার ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের সহায়তার জন্য প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি পর্যায়ে এ পর্যন্ত প্রদান করা অর্থের পরিমাণ ১২৭ কোটি ৬৭ লাখ ৩৩ হাজার ৩৪৯ টাকা।
গতকালের অনুষ্ঠানে সিপিডি জানায়, এখন পর্যন্ত ১৮ কোটি ৮৫ লাখ ৬০ হাজার টাকা খরচ করা হয়েছে। ৭৭৭ জন নিহত শ্রমিকের পরিবারকে প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে এককালীন এক লাখ করে টাকা দেওয়া হয়। এ ছাড়া ৪০ জন আহত শ্রমিককে ১০ থেকে ১৫ লাখ করে টাকা দেওয়া হয়। তবে এখনো অনেক শ্রমিক সহায়তার বাইরেই রয়ে গেছেন।
শ্রমসচিব মিকাইল শিপার বলেন, ডিএনএ পরীক্ষায় ১৫৭ জনের পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে। এখন তাদের একাধিক উত্তরাধিকার থাকায় কিছুটা সমস্যা আছে। তবে ১৩৬-১৩৮ জনকে শিগগিরই প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে আর্থিক সহায়তা দেওয়া হবে।
অনুষ্ঠানে বক্তারা প্রধানমন্ত্রীর তহবিলের অর্থ কীভাবে ব্যয় হচ্ছে, তার পূর্ণাঙ্গ হিসাব জনসম্মুখে প্রকাশ করার দাবি জানান। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের পরিচালনা পর্ষদের সদস্য শাহীন আনাম বলেন, ‘ক্ষতিপূরণসহ সব কাজে স্বচ্ছতা আনতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর তহবিলের টাকা কোথায় কীভাবে আছে সেটি আমরা জানি না। কিন্তু এই সরকার তথ্য অধিকার আইন পাস করেছে। তাই সরকারকে স্বপ্রণোদিত হয়ে এই তহবিলের তথ্য প্রকাশ করবে বলে আমরা আশা করি।’
প্রধানমন্ত্রীর তহবিলের অর্থ ব্যয়ের তথ্য জনসম্মুখে প্রকাশ করার আরও দাবি করেন সিপিডির বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য ও খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, বিলসের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জাফরুল হাসান, উন্নয়নকর্মী মরিয়ম বেগম ও স্থপতি ইকবাল হাবিব।
ইকবাল হাবিব বলেন, ওয়েব বেইজ পোর্টাল করে সবকিছু প্রকাশ করা দরকার। এখানে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের তালিকার পাশাপাশি কে কত আর্থিক সহায়তা পেলেন তার সবই থাকবে। অন্য সব কর্মকাণ্ডের তথ্যও রাখতে হবে। এটি হলে কারও মধ্যে বিভ্রান্তি থাকবে না