দেশের সরকারি পাটকলগুলোয় উৎপাদিত বিভিন্ন ধরনের পাটজাত পণ্যের বিক্রি ও রপ্তানি সম্প্রতি কমে গেছে। সে কারণে এসব পাটকলে এখন জমে গেছে পণ্যের স্তূপ।
বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) তথ্য অনুযায়ী, এ বছরের ২২ জানুয়ারি পর্যন্ত বিভিন্ন সরকারি পাটকলে ৮৩ হাজার ৬০০ টন পাটজাত পণ্য অবিক্রীত পড়ে আছে। এসব পণ্যের বাজারদর ৬০০ কোটি থেকে ৬৫০ কোটি টাকা।
বিশ্বব্যাপী পাটজাত পণ্যের রপ্তানি কমে যাওয়ার কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করেছে বিজেএমসি। এর মধ্যে আছে থাইল্যান্ড, সুদান ও মধ্যপ্রাচ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতা, সিরিয়ার বাজারে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বেড়ে যাওয়া, ইরানের ওপর আরোপিত অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা এবং ডলারের বিপরীতে ভারতীয় মুদ্রার মান কমে যাওয়া।
বিজেএমসির চেয়ারম্যান হুমায়ুন খালেদ প্রথম আলোকে বলেন, দেশে গত বেশ কয়েক মাসের রাজনৈতিক অস্থিরতা, বড় বাজার মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে অস্থিরতায় চাহিদা কমে যাওয়া, ডলারের বিপরীতে ভারতে রুপির দরপতন ঘটায় সে দেশের আমদানিকারকদের আমদানিতে অনীহাসহ কয়েকটি কারণে পাটজাত পণ্যের রপ্তানি বেশ কমেছে। আবার দেশীয় পাটকলগুলো বস্তা তৈরি করে বসে আছে। কিন্তু দেশীয় উদ্যোক্তারা এসব কিনছেন না। অথচ, সরকার বাধ্যতামূলক পাটের ব্যাগ ব্যবহারের জন্য আইনও করেছে। এসব কারণেই অনেক পাটকলে এখন উৎপাদিত পণ্যের মজুত পড়ে আছে।
দেশে এখন ২৬টি সরকারি পাটকল বিজেএমসির তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে। এর মধ্যে ২৩টি পাটকলে শুধুই পাটজাত পণ্য (যেমন—হেসিয়ান, পাটের বস্তা ও পাটের সুতা, কার্পেট ব্যাকিং ক্লথ—সিবিসি) তৈরি হয়। একটি পাটকলে অন্য সব পাটকলের জন্য যন্ত্রপাতি তৈরি হয়। আরেকটি পাটকলে জিও জুট ও টেক্সটাইল (মাটিকে সুরক্ষা দেওয়া একধরনের পাটের কাপড়) এবং পাট ও প্লাস্টিকের লেয়ারের চেয়ার-টেবিল তৈরি হয়। আরেকটি পাটকলে তৈরি হয় পাটের সুতা রাখার জন্য নলসহ কিছু সরঞ্জাম।
বিজেএমসির হিসাবে, বিজেএমসির আওতাধীন পাটকলগুলোতে প্রতিদিন বিভিন্ন ধরনের ৬৭৮ টন পাটজাত পণ্য উৎপাদিত হয়। এর ৫০ শতাংশই পাটের বস্তা। আর ১৫ থেকে ২০ শতাংশ উৎপাদিত হয় হেসিয়ান কাপড় ও ব্যাগ। এসব পাটকলে প্রতিবছরই পণ্য উৎপাদনের পরিমাণ বাড়ছে। ২০০৮-০৯ অর্থবছরে যেখানে এক লাখ নয় হাজার ৮২১ টন পণ্য উৎপাদিত হয়েছিল, সেখানে গেল ২০১২-১৩ অর্থবছরে উৎপাদিত হয়েছে এক লাখ ৯২ হাজার ৪০৮ টন পণ্য।
বিজেএমসি সূত্র জানায়, বিভিন্ন সরকারি পাটকলে বর্তমানে ২৩ হাজার ২৮ টন হেসিয়ান কাপড় ও ব্যাগ পড়ে আছে। পাটের বস্তা পড়ে আছে ৫২ হাজার ২৩ টন। কার্পেট ব্যাকিং ক্লথ (সিবিসি) জমেছে চার হাজার ৮৬৬ টন। সুতা জমে আছে দুই হাজার ৮৮৬ টন। আর জিও জুটজাত পণ্য, পাট ও প্লাস্টিকের লেয়ারের টেবিল-চেয়ারসহ অন্যান্য পণ্য জমেছে ৭৩২ টন।
পাটজাত পণ্যের উৎপাদন প্রতিবছর বাড়তে থাকলেও এ বছর ভাটার টান পড়েছে রপ্তানিতে। অবশ্য কয়েক বছর ধরে রপ্তানির পরিমাণ বাড়ছিল। ২০১২-১৩ অর্থবছরে এক হাজার ৩৬৩ কোটি ১৯ লাখ টাকার পণ্য রপ্তানি হয়েছে। তবে চলতি ২০১৩-১৪ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে রপ্তানি হয়েছে মাত্র ৩০৫ কোটি টাকার পণ্য। বিজেএমসি বলছে, ৯৫টি দেশে তাদের উৎপাদিত পাটপণ্য রপ্তানি হয়।
রপ্তানিকারকদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, দেশে পাট ও পাটজাত পণ্য রপ্তানি করে যে আয় হয় তার প্রায় অর্ধেকই আসে পাটের সুতা থেকে। বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি পাটের সুতা রপ্তানি হয় তুরস্কে। সেখানে বছরে গড়ে এক লাখ ৩০ হাজার টন পাটের সুতা রপ্তানি হতো। এ ছাড়া সিরিয়ায় ২৫ হাজার টন, মিসরে ২০ হাজার টন, ইরানে ৭৫ হাজার টন, ভারতে ৫০ হাজার টন ও চীনে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টন পাটের সুতা রপ্তানি হয়ে থাকে।
কিন্তু মিসর, সিরিয়া, তুরস্ক ও ইরানের বাজারের অবস্থা গত প্রায় এক বছর ধরেই খারাপ। সব সময় সহিংসতা চলতে থাকায় পাটপণ্যের রপ্তানিও কমে গেছে। চুক্তি করার পরও ওই সব দেশের আমদানিকারকেরা পণ্য জাহাজীকরণ করতে নিষেধ করছেন—এমন ঘটনাও ঘটেছে। এসব কারণে পাটপণ্যের দামও কমে গেছে।
আবার ভারতে ডলারের বিপরীতে রুপির দরপতনের প্রভাবে সে দেশে পণ্য রপ্তানিতেও ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। পণ্য আমদানিতে বেশি খরচ পড়ছে বলে আমদানিতে আগ্রহ হারাচ্ছে ভারতীয়রা।
বিজেএমসির চেয়ারম্যান হুমায়ুন খালেদ বলেন, ‘তুরস্ক আমাদের পণ্যের বড় ক্রেতা ছিল। সেখানে আমরা অন্যান্য পাটপণ্যের পাশাপাশি কার্পেট ব্যাকিং ক্লথ রপ্তানি করতাম। তারা এখন আর এই পণ্যটি নিচ্ছে না। কার্পেটের বদলে এখন টাইলসের দিকে চলে যাচ্ছে’। তিনি বলেন, ভারত সরকার সে দেশের পাট খাতে ভর্তুকি দিচ্ছে। ফলে তারা নিজেরা কম দামে পণ্য তৈরি করতে পারছে। এতে তাদের রপ্তানি যেমন বাড়ছে, তেমনি এ দেশ থেকে পণ্য আমদানিও কমিয়ে দিচ্ছে তারা।