ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দার হত্যাকাণ্ডে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির সাত ছাত্রসহ আটজনের জড়িত থাকার তথ্য-প্রমাণ পেয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। আজ রোববার বা কাল সোমবার এঁদের বিরুদ্ধে মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হবে।
তদন্ত তদারক কর্মকর্তা ডিবির উপকমিশনার শেখ নাজমুল আলম প্রথম আলোকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, তদন্তে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির সাত শিক্ষার্থী ও আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের প্রধান মুফতি মুহাম্মদ জসীমউদ্দিন রাহমানীর জড়িত থাকার তথ্য-প্রমাণ মিলেছে। গ্রেপ্তার হওয়া নর্থ সাউথের ছয় শিক্ষার্থীকে জিজ্ঞাসাবাদ, আদালতে দেওয়া তাঁদের জবানবন্দি এবং তদন্তে নিশ্চিত হওয়া গেছে, জসীমউদ্দিন রাহমানীর বই পড়ে এবং সরাসরি তাঁর বয়ান ও খুতবায় অংশ নিয়ে ‘নাস্তিক ব্লগার’দের খুন করতে তাঁরা উদ্বুদ্ধ ও উৎসাহিত হন। এরই ধারাবাহিকতায় ব্লগার রাজীব খুন হন। মামলার অভিযোগপত্রে রাহমানীকে ‘হত্যাকাণ্ডে অনুপ্রেরণাকারী’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী হলেন নর্থ সাউথের শিক্ষার্থী রেদোয়ানুল আজাদ ওরফে রানা। তাঁর গ্রামের বাড়ি ফেনীর দাগনভূঞার উত্তর জয়লস্করে। বাবার নাম আবুল কালাম আজাদ।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত ও হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে আছেন মো. ফয়সাল বিন নাঈম ওরফে দীপ (২২), মাকসুদুল হাসান ওরফে অনিক (২৩), মো. এহসান রেজা ওরফে রুম্মান (২৩), নাঈম সিকদার ওরফে ইরাদ (১৯), নাফিস ইমতিয়াজ (২২) ও সাদমান ইয়াছির মাহমুদ (২০)। তাঁরা সবাই নর্থ সাউথের ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক এবং ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড টেলিকমিউনিকেশন বিভাগের ছাত্র। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি তাঁদের বহিষ্কার করেছে।
মামলার আরেক তদন্ত তদারক কর্মকর্তা ডিবির জ্যেষ্ঠ সহকারী কমিশনার মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, প্রাপ্ত তথ্য-প্রমাণ অনুযায়ী, রেদোয়ানুলের পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয় শিক্ষার্থী গত ১৫ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর পল্লবীর পলাশনগরের নিজ বাড়ির কাছে ব্লগার রাজীবকে (৩২) চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেন। এ ঘটনায় পল্লবী থানায় হওয়া মামলার তদন্তের দায়িত্ব পায় ডিবি। ডিবি প্রথমে নর্থ সাউথের পাঁচ শিক্ষার্থীকে শনাক্ত করে। ১ মার্চ রাতে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর গ্রেপ্তার করা হয় আরেক শিক্ষার্থীকে। গ্রেপ্তার হওয়া ছয় শিক্ষার্থী ও জসীমউদ্দিন রাহমানী বর্তমানে কারাগারে আছেন। তবে মূল পরিকল্পনাকারী রেদোয়ানুল পলাতক। তাঁকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা অব্যাহত আছে।
তদন্ত-সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গ্রেপ্তারের পর আসামিরা বলেন, রাজীব খুন হওয়ার দেড় মাস আগে তাঁরা তাঁদের ইউনিভার্সিটির বড় ভাই রেদোয়ানুলের কাছে শুনে ‘থাবা বাবা’র ব্লগ পড়তেন। রাজীব হায়দার ‘থাবা বাবা’ নামে ব্লগ লিখতেন। ‘মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) নিয়ে অবমাননাকর লেখা দেখে তাঁরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন এবং লেখককে খুন করাটা তাঁদের ইমানি দায়িত্ব বলে মনে করেন।’ এরপর রেদোয়ানুলের নেতৃত্বে নর্থ সাউথের নামাজের ঘরে তাঁরা বৈঠক করে ব্লগার রাজীবকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। তাঁরা ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে রাজীবের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করতে থাকেন। একপর্যায়ে শাহবাগের আন্দোলন শুরু হওয়ার পর তাঁরা রাজীবের ফেসবুকের স্ট্যাটাস থেকে জানতে পারেন, রাজীব শাহবাগে যাবেন। এরপর এহসান রেজা নামের তাঁদের একজন গত ৯ ফেব্রুয়ারি শাহবাগে গিয়ে রাজীবকে শনাক্তের চেষ্টা করেন। তিনি ফেসবুকের বন্ধুদের সূত্র ধরে দু-এক দিনের মধ্যে আবার শাহবাগে গিয়ে রাজীবকে শনাক্ত করেন।
মামলার তদন্তকারী ডিবির পরিদর্শক নিবারণ চন্দ্র বর্মণ বলেন, মামলার খুঁটিনাটি তদন্ত শেষে ১১ মাসের মাথায় আলোচিত এ মামলার অভিযোগপত্র দাখিল করা হচ্ছে। মামলার বাদী ও নিহতের বাবা নিজামউদ্দিন, হত্যাকাণ্ডস্থলের আশপাশের লোকজন, পুলিশ ও চিকিৎসকসহ ৫৫ জনকে মামলায় সাক্ষী করা হয়েছে। হত্যার আগে যে দোকান থেকে আসামিরা সিমকার্ড ও চাপাতি-ছুরি কিনেছিলেন, দোকানমালিকেরা এ বিষয়ে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
ডিবির সূত্র জানায়, মামলাটি প্রথমে তদন্ত করেন ডিবির পরিদর্শক মো. মাইনুল ইসলাম। তাঁর বিরুদ্ধে মামলা ভিন্ন খাতে নেওয়ার অভিযোগ ওঠায় তাঁকে তদন্তভার থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।
ডিবির কর্মকর্তা তৌহিদুল ইসলাম বলেন, রাজীবের হত্যাকারীরা ধর্মভিত্তিক উগ্র মতাদর্শে বিশ্বাসী।
মামলার বাদী ও রাজীবের বাবা নিজামউদ্দিন গতকাল শনিবার প্রথম আলোকে বলেন, হত্যাকারীদের সঙ্গে রাজীবের কোনো বিরোধ ছিল না। তারা চিনতও না রাজীবকে। তিনি আরও জানান, পরিকল্পনাকারী রেদোয়ানুল ধরা পড়লে এর পেছনে প্রভাবশালী কারা আছে, হত্যার উদ্দেশ্য ও কারণ জানা যেত। তিনি মনে করেন, শাহবাগের আন্দোলন থামাতে একটি বড় চক্র রাজীবকে হত্যায় নর্থ সাউথের শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করেছে।