ঝড় বইছে ক্রিকেট-বিশ্বজুড়েই। তবে বাংলাদেশে সেই ঝড়ের সঙ্গে যোগ হয়েছে ‘দমকা হাওয়া’।
টেস্ট খেলুড়ে অন্য সব দেশ লাভ-ক্ষতির অঙ্ক করছে। সম-অধিকার হারিয়ে তিন দেশের কর্তৃত্ব মেনে নেওয়ার ‘লজ্জা’ নিয়ে ভাবছে। বাংলাদেশের ভাবনা অত দূর বিস্তৃত হওয়ার সুযোগই পাচ্ছে না। এখানে জনমনে ফণা তুলছে শুধু একটাই প্রশ্ন—অনেক সাধনায় অর্জিত বাংলাদেশের টেস্ট খেলার অধিকার কি কেড়ে নেওয়া হবে?
এই প্রশ্নই কাল বিকেলে শাহবাগে টেনে আনল হাজারো জনতাকে। সেখানে একটা প্ল্যাকার্ড একটু বেশিই দৃষ্টি কাড়ল—‘তিন শিয়ালের কাছে মুরগি বর্গা দিব না’। এখানে তিন ‘শিয়াল’ মানে ভারত, ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া। এই তিন দেশের ক্রিকেট বোর্ডের তিন প্রধান মিলে ‘পজিশন পেপার’ নামে যে প্রস্তাব তৈরি করেছেন, সেটি টান দিচ্ছে আইসিসির ভিত্তিমূল ধরেই। জাগিয়ে তুলেছে টেস্ট ক্রিকেট থেকে বাংলাদেশের অবনমনের শঙ্কাও।
গোপনে এই নকশা তৈরি হচ্ছিল অনেক দিন ধরেই। ৯ জানুয়ারি দুবাইয়ে আইসিসির এক বিশেষ সভায় এই প্রস্তাবের খসড়া ধরিয়ে দেওয়া হয় আইসিসির অন্য সব সদস্যদেশের হাতে। তার পরও এটি গোপনই ছিল। কদিন আগে একটি ওয়েবসাইট এটি ফাঁস করে দেওয়ার পরই ক্রিকেট-বিশ্বে তোলপাড় শুরু।
কাগজে-কলমে প্রস্তাবটা আইসিসির অর্থ ও বাণিজ্য (এফঅ্যান্ডসিএ) কমিটির ‘ওয়ার্কিং গ্রুপ’-এর। তবে ওই তিন বোর্ডের প্রধান ছাড়া এফঅ্যান্ডসিএ কমিটির বাকি ছয় সদস্যের কেউই এ ব্যাপারে অবগত ছিলেন না। সবার কাছে তাই বিস্ময় হয়েই এসেছে বিতর্কিত ও অগণতান্ত্রিক চিন্তাভাবনায় আচ্ছন্ন এই প্রস্তাব।
তা কী আছে ওই ‘পজিশন পেপারে’? মূল প্রস্তাবগুলোর প্রায় সব কটির একটাই লক্ষ্য, আইসিসিতে ওই তিন দেশের নিরঙ্কুশ আধিপত্য প্রতিষ্ঠা। যেটির প্রথমেই আছে, আইসিসির পূর্ণ সদস্যদেশগুলোর সম-অধিকার ক্ষুণ্ন করে এক্সকো নামে নতুন একটি কমিটি গঠনের প্রস্তাব। যেটির স্থায়ী সদস্য হিসেবে থাকবে বোর্ড অব কন্ট্রোল ফর ক্রিকেট ইন ইন্ডিয়া (বিসিসিআই), ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া (সিএ) ও ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলশ ক্রিকেট বোর্ড (ইসিবি)। কমিটিতে বাকি সাতটি পূর্ণ সদস্যদেশের প্রতিনিধি হিসেবে থাকবেন শুধু একজন। আইসিসির বাকি সব কমিটির ওপর এটির কর্তৃত্ব থাকবে অর্থাৎ এটিই হবে বিশ্ব ক্রিকেটের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা।
টাকার লোভের কাছে খেলার মূল চেতনা অনেক দিন ধরেই গৌণ হয়ে যেতে বসেছে। প্রস্তাবিত ‘পজিশন পেপারে’ সেটি প্রকাশিত হয়েছে আরও উৎকট রূপে। এত দিন বিশ্বকাপের মতো বৈশ্বিক টুর্নামেন্টগুলো থেকে আইসিসির আয়ের অঙ্কের ভাগটা টেস্ট খেলুড়ে সব দেশের জন্যই ছিল সমান। ওই তিন দেশের দাবি, এই আয়ের সিংহভাগেরই জোগান দেয় বলে তাদের বেশি ভাগ দিতে হবে। অনুমিতভাবেই বিসিসিআই এই দাবির পুরোভাগে। তাদের হিসাব অনুযায়ী, আইসিসির রাজস্বের ৮০ শতাংশই আসে ভারত থেকে। তাহলে কেন তারা বেশি পাবে না? শুধু বেশি দাবি করেই ক্ষান্ত হয়নি বিসিসিআই। ওয়ার্কিং কমিটির সভায় নেওয়া সিদ্ধান্তকে হুমকির আকারে জানিয়েও দিয়েছে—এই প্রস্তাব গৃহীত না হলে আইসিসি টুর্নামেন্টগুলোয় ভারত অংশ নেবে না।
আইসিসির এত দিনের নিয়মনীতি বদলে দেওয়ার এমন আরও সব প্রস্তাব আছে ওই ‘পজিশন পেপারে’। তবে বাংলাদেশের সেসব নিয়ে খুব বেশি মাথাব্যথা নেই। বাংলাদেশের মূল দুশ্চিন্তা টেস্ট ক্রিকেটে উত্তরণ আর অবনমনের নিয়ম প্রবর্তনের প্রস্তাব নিয়ে। যাতে বলা হয়েছে, টেস্ট র‌্যাঙ্কিংয়ে ৯ ও ১০ নম্বর দল অবনমিত হয়ে আইসিসির সহযোগী সদস্যদেশগুলোর সঙ্গে চার দিনের ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপে খেলবে। সেটিতে চ্যাম্পিয়ন হলে সুযোগ পাবে র‌্যাঙ্কিংয়ে ৮ নম্বর দলের সঙ্গে প্লে-অফ খেলার। হোম অ্যান্ড অ্যাওয়ে দুটি করে টেস্ট ম্যাচ খেলার পর জয়ী দল টিকে যাবে টেস্ট ক্রিকেটে। এই চিন্তার ভিত্তি বলা হচ্ছে ‘মেরিটোক্রেসি’কে। অর্থাৎ খেলার মানটাই এখানে বিবেচ্য। অথচ পরস্পর বিরোধিতার চূড়ান্ত রূপ বলা যায় সংযুক্ত ধারাটিকেই—ওই তিন দেশ, ভারত, ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া কখনোই অবনমিত হবে না। এটির পক্ষে যুক্তি, এই তিন দেশ না থাকলে বাণিজ্যে ভাটা পড়বে। অর্থাৎ কোথাও হচ্ছে মানের বিচার, কোথাও বা কোন দল কোষাগারে কত বেশি অর্থ জোগান দিতে পারবে, সেই হিসাব।
বলা হচ্ছে, ৯ ও ১০ নম্বর দল। প্রকারান্তরে যা আসলে ‘জিম্বাবুয়ে ও বাংলাদেশ’ বলে দেওয়ার মতোই। অনেক দিন ধরে এই দুটি দলই টেস্ট ক্রিকেটের সবচেয়ে তলানির দুই দল এবং টেস্ট পরিবারের নবীনতম দুই সদস্য হিসেবে সেটি খুব অস্বাভাবিকও নয়। এমনিতেই ফিউচার ট্যুর প্রোগ্রামে (এফটিপি) এই দুই দেশের প্রতি চরম বৈষম্য। এখন তো এফটিপিই তুলে দেওয়ার প্রস্তাব করা হচ্ছে। উন্নতি করার একমাত্র পথ বড় দলগুলোর সঙ্গে আরও নিয়মিত খেলা। সেখানে উল্টো অবনমিত হয়ে গেলে বাংলাদেশের ক্রিকেটের সামনে ঘোর অন্ধকার।
বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের তাই এই প্রস্তাবের বিপক্ষে রুখে দাঁড়ানো ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। অথচ গত বৃহস্পতিবারের বোর্ড সভার পর সংবাদমাধ্যমে যা প্রকাশিত হয়েছে, তাতে দেশের ক্রিকেটপ্রেমীরা রীতিমতো হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন। সংবাদ সম্মেলনে বিসিবির সভাপতি কূটনৈতিক কথাবার্তা বললেও বিসিবিতে নাকি ২০-৩ ভোটে এই প্রস্তাব সমর্থন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এটিকে ‘বিভ্রান্তিমূলক’ বলে অবশ্য পরদিনই ব্যাখ্যা দিয়েছে বিসিবি। আর গতকাল তো বিসিবির মুখপাত্র জালাল ইউনুস জানিয়ে দিলেন, টেস্ট ক্রিকেট থেকে অবনমনের প্রস্তাবের ব্যাপারে বিসিবির অবস্থান স্পষ্ট। এটি মেনে নেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, বাংলাদেশের মেনে নেওয়া না-নেওয়ার গুরুত্ব কতটুকু? বিশ্ব ক্রিকেটে বাংলাদেশের কণ্ঠস্বর এতটা জোরালো নয় যে, সেটি সবাই শুনতে বাধ্য হবে। তবে এই ‘লড়াই’য়ে বাংলাদেশ বোধ হয় নিঃসঙ্গ নয়। দেশে ও দেশের বাইরে নানা সূত্রে যা আভাস পাওয়া গেছে, তাতে ওই তিন দেশ এবং প্রকাশ্যে এই প্রস্তাবের প্রতি সমর্থন জানানো নিউজিল্যান্ড ছাড়া বাকি ছয়টি টেস্ট খেলুড়ে দেশের পাঁচটি এ ব্যাপারে আইসিসির সভায় এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেবে। বিস্ময়কর হলো, বাংলাদেশের মতো একই পরিণতির আশঙ্কায় পড়া জিম্বাবুয়ে এই পাঁচ দেশের মধ্যে নেই। আর্থিক সংকটে জর্জরিত জিম্বাবুয়ে নাকি বাড়তি অর্থের আশায় বিনা প্রতিবাদে এই প্রস্তাব মেনেও নিতে পারে।
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন অবশ্য অন্য—আগামী ২৮-২৯ জানুয়ারি দুবাইয়ে অনুষ্ঠেয় আইসিসির নির্বাহী বোর্ডের সভায় এই প্রস্তাব অনুমোদনের জন্য টেবিলে উঠবে কি না? আইসিসির মুখপাত্র জন লংয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি এ ব্যাপারে মন্তব্য করতে রাজি হননি।

তিন দেশের বিতর্কিত প্রস্তাবে যা আছে
১. আইসিসির নতুন নির্বাহী কমিটিতে (এক্সকো) স্থায়ী সদস্য থাকবে ভারত, ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া। আইসিসির সব কমিটিতে এর কর্তৃত্ব থাকবে
২. টেস্টে উত্তরণ ও অবনমন থাকবে। র‌্যাঙ্কিংয়ে ৯ ও ১০ নম্বর দল আইসিসির সহযোগী দেশগুলোর সঙ্গে ইন্টারকন্টিনেন্টাল কাপে খেলবে। জয়ী দল ৮ নম্বর দলের সঙ্গে প্লে-অফ খেলে ওপরে ওঠার সুযোগ পাবে। ভারত, ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া অবনমিত হবে না
৩. ফিউচার ট্যুর প্রোগ্রাম (এফটিপি) থাকবে না। দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে সিরিজ ঠিক হবে
৪. আইসিসির রাজস্ব বণ্টন হবে আয়ে সেই দেশের ভূমিকার ভিত্তিতে
৫. আইসিসির শীর্ষ পদ— আইসিসি চেয়ারম্যান, এক্সকো এবং অর্থ ও বাণিজ্য কমিটির চেয়ারম্যান হবেন ভারত, ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার প্রতিনিধিরা