৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের আগের রাত থেকে দেশজুড়ে সহিংসতায় ৩১৫টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় নামে-বেনামে আসামি করা হয়েছে ৬৩ হাজারের বেশি লোককে। এই আসামিদের ধরতে চলছে যৌথ বাহিনীর অভিযান।
এই অভিযানে পুলিশের হিসাব অনুসারে চলতি মাসের ১০ দিনেই গ্রেপ্তার হয়েছে ২২ হাজারের বেশি লোক। তবে পুলিশ কর্মকর্তাদের দাবি, ২২ হাজারের মধ্যে নিয়মিত আসামিও রয়েছে।
এদিকে যৌথ বাহিনীর অভিযানকে কেন্দ্র করে নিরীহ মানুষকে হয়রানি ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ উঠেছে। নির্বাচনের পর থেকে এ পর্যন্ত কথিত বন্দুকযুদ্ধে ১৩ জন নিহত হয়েছেন। গত শনিবার রাতে সাতক্ষীরা ও ঝিনাইদহে যৌথ বাহিনীর সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত তিনজনই জামায়াত-শিবিরের কর্মী।
সংবাদপত্রে প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায়, ১৩ জনের মধ্যে নয়জন যৌথ বাহিনীর অভিযানের সময় কথিত বন্দুকযুদ্ধে মারা যান। আর চারজনের লাশ গুলিবিদ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করা হয়।
বিএনপির পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করে ১৮৭ নেতা-কর্মীকে গুম করার অভিযোগ করা হয়েছে। যদিও এর কোনো পূর্ণাঙ্গ ও সুনির্দিষ্ট তালিকা বিএনপি দিতে পারেনি।
পুলিশের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান, নির্বাচন বানচাল করতে তফসিল ঘোষণার (২৫ নভেম্বর) দিন থেকেই দেশব্যাপী সহিংস তৎপরতা শুরু করেন বিএনপি-জামায়াতের কর্মীরা। আগুন ও ভাঙচুর করা হয় পাঁচ শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। হামলা করা হয় আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বাড়িঘর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে। ভোটের পরে যশোর, সাতক্ষীরা, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুরসহ কয়েক জায়গায় হিন্দু বসতিতে হামলা চালানো হয়। এরপর সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশে দেশব্যাপী অভিযানে নামে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
তফসিল ঘোষণা থেকে ভোট গ্রহণের আগের দিন পর্যন্ত সহিংস ঘটনায় কত মামলা হয়েছে, আসামির সংখ্যা কত—সে সম্পর্কে সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। প্রথম আলোতে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই সময়ে, অর্থাৎ তফসিল ঘোষণা থেকে নির্বাচনের পরদিন পর্যন্ত সারা দেশে নিহত হয়েছেন ১৪৬ জন। এর মধ্যে নির্বাচনের দিন ও পরদিন মারা গেছেন ২৪ জন। জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এত বিপুল প্রাণহানির ঘটনা দেশে আর কখনো ঘটেনি।
এখন আসামি গ্রেপ্তারের নামে সাধারণ মানুষকে হয়রানির অভিযোগ উঠেছে। আছে গ্রেপ্তার-বাণিজ্যের অভিযোগও। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান গতকাল প্রথম আলোকে বলেছেন, এভাবে সন্দেহভাজন আসামি গ্রেপ্তার স্রেফ ব্যবসার জন্য এবং লোক দেখানো।
তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন পুলিশের মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার। প্রথম আলোকে তিনি বলেছেন, সুশৃঙ্খল বাহিনীর কার্যকলাপ নিয়ে এ রকম ঢালাও অভিযোগ করা সমীচীন নয়। পুলিশ কাজ করে আইনের আওতায়। কোথাও যদি তার ব্যত্যয় ঘটে, সে ক্ষেত্রে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ আছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাব অনুসারে, নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতায় দেশের ১৪টি স্থানে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে হামলার ঘটনায় ১৮টি মামলা হয়েছে। ২৫ জেলায় মোট ৩১৫টি মামলার মধ্যে সংখ্যার দিক থেকে সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে যশোরে, ৬৩টি। গাইবান্ধায় ৫৩, দিনাজপুরে ৪৬, লক্ষ্মীপুরে ৩১ ও ঠাকুরগাঁওয়ে ২০টি মামলা হয়েছে। বেশির ভাগ মামলায় আসামি ‘অজ্ঞাত’ হিসেবে উল্লেখ রয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাবে নির্বাচনের পর ১৭ জানুয়ারি থেকে ২৬ জানুয়ারি পর্যন্ত ১০ দিনেই গ্রেপ্তার হয়েছে ২২ হাজার ৪৮৯ জন। তবে এসব আসামির মধ্যে পুলিশের নিয়মিত গ্রেপ্তারের আসামিও রয়েছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
এদিকে বিভিন্ন স্থানে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার ঘটনা ‘ক্রসফায়ার’ নয় দাবি করেছেন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। গত রাতে বিবিসিকে তিনি বলেন, ‘এগুলো ক্রসফায়ার নয়। অপারেশনের সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ওপর আক্রমণ চালালে তারাও আত্মরক্ষার জন্য পাল্টা আক্রমণ চালায়। তখনই এসব হতাহতের ঘটনা ঘটে। সরকারবিরোধীদের ধরে নিয়ে হত্যা করার অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ধরে নিয়ে হত্যা করার অভিযোগ সঠিক নয়।
নির্বাচনকেন্দ্রিক অস্থিরতার পাশাপাশি মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের রায়কে কেন্দ্র করে সহিংসতায় ২০১৩ সালে ৫০৭ জন মারা যান। আহত হয়েছেন ২২ হাজার ৪০৭ জন। এর আগে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারির একতরফা নির্বাচন-পূর্ব সহিংসতায় ৪১ জন মারা যান।