গত জুলাই থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত সময়ে দেশে হরতাল, অবরোধ ও রাজনৈতিক সহিংসতায় চার খাতে প্রায় ৪৯ হাজার ১৮ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। এই ক্ষতির পরিমাণ মোট দেশজ আয়ের ৪ দশমিক ৭ শতাংশ। ওই সময়ে দেশে ৫৫ দিন হরতাল ও অবরোধ হয়েছে।
গতকাল শনিবার বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অর্থনৈতিক এক পর্যালোচনায় এ তথ্য তুলে ধরা হয়। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসের তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে ‘বাংলাদেশ অর্থনীতি-২০১৩-১৪’ শিরোনামে রাজধানীর ধানমন্ডির সিপিডি কার্যালয়ে দ্বিতীয় অন্তর্বর্তীকালীন এই পর্যালোচনা তুলে ধরা হয়। তাতে চলতি অর্থবছর শেষে ৫ দশমিক ৬ থেকে ৫ দশমিক ৮ শতাংশ পর্যন্ত জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) প্রবৃদ্ধি হবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে। সিপিডি বলছে, জিডিপির নতুন ভিত্তি বছর হিসাবে এই প্রাক্কলন করা হয়েছে। যদিও অর্থমন্ত্রী এবারের প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৩ শতাংশের কম হবে না বলে জানিয়েছেন।
অর্থবছরের প্রথমার্ধে চার খাতের আর্থিক ক্ষতির হিসাব দিয়ে সিপিডি বলেছে, রেল ও সড়ক যোগাযোগ খাতে ১৬ হাজার ৬৮৯ কোটি টাকা, কৃষি ও কৃষিজাত শিল্প খাতে ১৫ হাজার ৮২৯ কোটি, রপ্তানিমুখী বস্ত্রশিল্পে ১৩ হাজার ৭৫০ কোটি এবং পর্যটন খাতে দুই হাজার ৭৫০ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে সিপিডির পর্যালোচনা তুলে ধরেন সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান আর বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন গবেষণা পরিচালক ফাহমিদা খাতুন, পরিচালক (সংলাপ ও যোগাযোগ) আনিসাতুল ফাতেমা ইউসুফ, অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক খোন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান প্রমুখ।
সংবাদ সম্মেলনে সিপিডি বলছে, জনপ্রত্যাশা ও অর্থনীতির শক্তির ভিত্তিতে উচ্চ প্রবৃদ্ধির যে সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছিল, সেটি হারিয়ে গেছে। উচ্চ প্রবৃদ্ধির সেই ত্বরণ ফিরিয়ে আনা সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। অর্থনীতির কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধির স্বার্থে রাজনৈতিক সমঝোতার প্রয়োজনীয়তার কথাও তুলে ধরা হয় সিপিডির পর্যালোচনায়। বলা হয়েছে, রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়া বিনিয়োগ আকর্ষক নীতি ধারাবাহিকতা বজায় রাখা কঠিন। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আসবে না। সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন ছাড়া রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা দূর করা সম্ভব নয়।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, অর্থনীতিতে বর্তমানে যে আপাত শান্তি বা স্থিতি বিরাজ করছে, তার ফলে কিছু শিল্পের চলমান কার্যকারিতার দক্ষতা বাড়বে। কিন্তু আগামী দিনের নতুন বিনিয়োগকে নিশ্চিত করতে পারবে বলে মনে হয় না। তাই অর্থনীতিকে সম্প্রসারণ করতে হলে নীতি অনিশ্চয়তা দূর করতে হবে। নীতি গ্রহণ ও বাস্তবায়নের জন্য অবশ্যই সামাজিক সংলাপ করতে হবে। রাজনৈতিক বিরোধীদের সঙ্গেও আলোচনা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে সরকারের স্থায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন থাকলে বিনিয়োগের অনিশ্চয়তা কাটবে না।
দেবপ্রিয় বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত একটি সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক এবং আস্থাভাজন নির্বাচন হবে না ততক্ষণ পর্যন্ত রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা সম্পূর্ণভাবে কাটবে না। দীর্ঘ মেয়াদে বিনিয়োগে দ্বিধা থেকে যাবে।
সংবাদ সম্মেলনে সিপিডির বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, নির্বাহী পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান ও গবেষণা পরিচালক ফাহমিদা খাতুন । ছবি: প্রথম আলোপ্রতিবেদন: স্বল্প মেয়াদে অর্থনীতিকে গতিময় করতে সিপিডির পক্ষ থেকে চার দফা সুপারিশ তুলে ধরা হয়। সেগুলো হলো—সরকারের আয়-ব্যয়ের কাঠামো দ্রুত ও বাস্তবতার ভিত্তিতে পুনর্নির্ধারণ, বোরো চাষ ও ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামীণ অর্থনীতিকে সমর্থন, রপ্তানিমুখী শিল্পসহ রাজনৈতিক সহিংসতায় যেসব শিল্প লোকসানে পড়েছে সেগুলোকে সহায়তা এবং বিনিয়োগকে উৎসাহিত করতে নীতি অনিশ্চতয়তা দূর।
নীতি অনিশ্চয়তা দূর করতে হলে রাজনৈতিক ও সামাজিক সমঝোতা প্রয়োজন বলে মত দেয় সিপিডি। সংস্থাটির মতে, রাজনৈতিক বিরোধীদের সঙ্গে আলোচনা না করে কোনো নীতি গ্রহণ করা হলে সেটির বাস্তবায়ন নিয়ে একধরনের অনিশ্চয়তা থেকে যায়। সবার অংশগ্রহণের ভিত্তিতে একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন না হলে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা কাটবে না।
রাজস্ব খাত: সংস্থাটির পর্যালোচনায় বলা হয়, অর্থবছরের প্রথমার্ধে রাজনৈতিক সহিংসতায় শিল্প, অর্থনীতি ও সেবা খাতের কর্মকাণ্ডের শ্লথ গতির কারণে রাজস্ব আদায়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) চলতি বছর ২৫ দশমিক ৩ শতাংশ রাজস্ব প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করলেও প্রথম পাঁচ মাসে (জুলাই-নভেম্বর) মাত্র ১৪ দশমিক ৪ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ফলে বছর শেষে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না বলে মনে করছে সিপিডি।
সিপিডির মতে, রাজস্ব আদায় কমার পাশাপাশি সরকারি ব্যয়ও কমে গেছে। এ কারণে সরকারের আয়-ব্যয় কাঠামোটি বাস্তবতার ভিত্তিতে দ্রুত পুনর্নির্ধারণ করতে হবে। উন্নয়ন ব্যয়ের ক্ষেত্রে বড় ও এ বছর সমাপ্য প্রকল্পগুলোকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
কৃষি খাত: আউশ ও আমনের প্রবৃদ্ধিকে সন্তোষজনক উল্লেখ করলেও বোরোর প্রবৃদ্ধি নিয়ে শঙ্কা সিপিডির। সিপিডির প্রতিবেদন অনুযায়ী, বোরো বপন বা রোপণের কাজটি এখনো চলমান, এতে কিছুটা বিলম্ব ঘটেছে। এখন প্রয়োজনীয় উপকরণ যথাযথ ও সঠিক সময়ে সরবরাহের মাধ্যমে চাষের নিশ্চয়তা দিতে হবে। সেই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত গ্রামীণ অর্থনীতির সহায়তায় প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে। পোলট্রি শিল্পের ক্ষতি পোষাতে এ খাতের ব্যবসায়ীদের জন্য বিশেষ প্রণোদনার সুপারিশ করেছে সিপিডি।
ব্যাংক খাত: পর্যালোচনায় বলা হয়, ব্যাংক খাতে উদ্বৃত্ত তারল্য বা অলস অর্থের পরিমাণ প্রায় ৭৪ শতাংশ বেড়েছে। টাকা নিয়ে ব্যাংকগুলো বসে আছে। এতে ব্যাংকগুলোর তহবিল ব্যবস্থাপনা ব্যয় (কস্ট অব ফান্ড) বেড়ে যাচ্ছে, যা সুদের হারে প্রভাব ফেলছে। অর্থনীতির জন্য এটি দুশ্চিন্তার বিষয়।
রপ্তানি খাত: যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের বাজারে প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা সম্ভব হলেও রপ্তানির ক্ষেত্রে সরকারের বাজারভিত্তিক নজরদারি প্রয়োজন বলে মনে করে সিপিডি। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক অস্থিরতায় তৈরি পোশাক খাতের ব্যবসায়ীরা আকাশপথে পণ্য সরবরাহের মাধ্যমে রপ্তানির বাজার ধরে রেখেছে। এতে লাভের পরিমাণ কমেছে।
ক্ষতিগ্রস্ত খাত: সিপিডি বলছে, রাজনৈতিক সহিংসতায় কৃষি, পরিবহনসহ বিভিন্ন খাতের ক্ষুদ্র উৎপাদকেরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। রপ্তানিমুখী শিল্পের চেয়ে দেশীয় বাজারনির্ভর শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো এ ক্ষেত্রে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। এতে এ খাতে প্রবৃদ্ধির হার কমেছে। অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে রপ্তানিনির্ভর শিল্পে প্রায় ১২ শতাংশ হলেও দেশীয় বাজারনির্ভর শিল্পে প্রবৃদ্ধির এ হার ছিল প্রায় সাড়ে সাত শতাংশ।
তাই সরকারের পক্ষ থেকে নীতি সহায়তা প্রদানের ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত সবার বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। যাদের পক্ষে জোরালোভাবে ক্ষতির চিত্র তুলে ধরার শক্তি নেই তাদের কাছেও সরকারের প্রণোদনা পৌঁছে দিতে হবে। বিভিন্ন খাতে প্রণোদনা দিতে গিয়ে তার দায় যেন ব্যাংকের ওপর এসে না পড়ে সে জন্য আলাদা তহবিল গঠনের পরামর্শ দিয়েছে সিপিডি।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, জাতীয় সম্পদের এক শতাংশ ক্ষতি হলে প্রবৃদ্ধির শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ পতন ঘটে। ক্ষতির চিত্র তুলে ধরে দেবপ্রিয় বলেন, বেশির ভাগ সময় মনে করা হয় রপ্তানিমুখী শিল্প সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু আমাদের হিসাবে প্রথমে এসেছে কৃষি ও কৃষিজাত খাত, রপ্তানিমুখী শিল্প তৃতীয় অবস্থানে ছিল। সরকার যদি ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের সহায়তা দিতে চায় তাহলে কারা বেশি এই সহায়তা পাওয়ার যোগ্য তা এই বিশ্লেষণের মাধ্যমে পরিষ্কার হয়ে উঠেছে।