বিমানবন্দর পার হওয়ার পরেই টঙ্গীমুখী বিশেষ জনস্রোতটি স্পষ্ট হয়ে উঠছিল। বিশেষ বলা এ কারণে যে পথের উভয় পাশে চলমান অনেক লোকের মধ্যে তাঁদের আলাদা করে চেনা যাচ্ছিল বেশভূষা দেখেই। অধিকাংশের পরনে পাঞ্জাবি, মাথায় টুপি। হরেক রকমের বাহন তাঁদের। ব্যক্তিগত গাড়ি, মোটরসাইকেল, গণপরিবহনের মিনি বা দোতলা বাস, পিকআপ ভ্যান থেকে বাইসাইকেল পর্যন্ত। উপরন্তু, পদব্রজে ফুটপাত ধরে চলছেন মিছিলের মতো অসংখ্য জন। বেলা তখন সবে এগারো পেরিয়েছে।
আজমপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে পথের পশ্চিম পাশে যানবাহনগুলো থমকে আছে। কচ্ছপের চেয়েও ধীর গতিতে দু-চার হাত এগিয়ে আবার থমকে যাচ্ছে মিনিট চার-পাঁচেকের জন্য। সেই জটলার ভেতর দিয়ে টঙ্গী সেতু পার হওয়ার পর সামনের দৃশ্য দেখে মনে হলো আক্ষরিক অর্থেই জনসমুদ্র। বিশ্ব ইজতেমার শুরুর দিন গতকাল শুক্রবার এই মহা জনসমারোহ সৃষ্টি হয়েছিল তুরাগতীরে।
ইজতেমায় মুসল্লিদের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়তে থাকায় ২০১১ সাল থেকে তিন দিনের এই ধর্মীয় সমাবেশ অনুষ্ঠিত হচ্ছে দুটি পর্বে। এবার প্রথম পর্ব শুরু হলো পবিত্র জুমাবারে। দিনটি ছুটিরও। সে কারণে ঢাকা শহর ও আশপাশের এলাকা থেকে অসংখ্য মুসল্লি ইজতেমার মাঠে আসছিলেন জুমার জামাতে অংশ নিতে। কাল রোববার দুপুরে আখেরি মোনাজাতের মধ্য দিয়ে ইজতেমার প্রথম পর্ব শেষ হবে। দ্বিতীয় পর্ব শুরু হবে ৩১ জানুয়ারি থেকে ২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত।
তাবলিগের সাথিরা বুধবার থেকেই ইজতেমায় অংশ নিতে তুরাগতীরে সমবেত হতে থাকেন। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার আগেই তাঁদের উপস্থিতিতে মাঠ ভরে ওঠে। কারা ইজতেমার কোন পর্বে অংশ নেবেন, তা আগে থেকেই নির্ধারিত থাকে। খুবই সুশৃঙ্খল নিয়ম-পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে এই বিশাল সমাবেশ এবং তাবলিগের দীনের কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
তিন দিনে ইজতেমার কার্যক্রম ৭২ ঘণ্টা। শেষ দিন দুপুরে আখেরি মোনাজাত হয় বলে বাকি সময়টুকু পূরণ করা হয় আনুষ্ঠানিকভাবে শুরুর আগের দিন সন্ধ্যায় ‘আমবয়ানের’ মধ্য দিয়ে। সে অনুযায়ী গত বৃহস্পতিবার মাগরিবের পর থেকেই এবারের ইজতেমার আমবয়ান শুরু হয়েছিল। বয়ান করেছিলেন পাকিস্তানের মাওলানা আবদুল ওয়াহাব। গতকাল শুক্রবার বাদ ফজর বয়ান করেন ভারতের মাওলানা ইসমাইল হোসেন। জুমার নামাজে ইমামতি করেন ঢাকার মাওলানা জোবায়রুল হোসেন। এরপর বয়ান করেন মাওলানা মোহাম্মদ হোসেন। এবার দেশ-বিদেশের প্রায় ১০ লাখ মুসল্লি প্রথম পর্বে অংশ নিয়েছেন। বাড়তি ছিলেন জুমার নামাজে আসা মুসল্লিরা। ফলে কালো-কুটিল পানির মরা তুরাগতীর উছলে পড়েছিল জনবন্যায়। নদের সেতু, আশপাশের পথ, এমনকি আশপাশের বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়েও জামাতে অংশ নেন অনেকে।
ইজতেমা উপলক্ষে ওই এলাকার পরিবেশটাই বদলে গেছে। মহাসড়ক থেকে মাঠ অভিমুখী পথগুলোর পাশ দিয়ে বসেছে হরেক রকমের পণ্যের পসরা। শীতের কাপড় থেকে শুরু করে ধর্মীয় বই, তসবি-টুপি-জায়নামাজ, চিড়া-গুড়, মাছ-গোস্ত, সবজি-লাকড়ি, প্লাস্টিকের মগ, বদনা, সেলফোনের চার্জার—কী নেই সেখানে!
এই বিপুল সরগরম পসরা পেরিয়ে মাঠে এলে আবার অন্যরকম পরিবেশ। লাখ লাখ মানুষ, অথচ তেমন উচ্চবাচ্য নেই। শামিয়ানা টানানো মাঠের পাশের পথে খানিক পরপরই আছেন তাবলিগের স্বেচ্ছাসেবীরা। জিজ্ঞাসা করা মাত্র তাঁরা অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে পথ বাতলে দিচ্ছেন কোন দিক দিয়ে কোন খিত্তায় যেতে হবে। মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ‘ভাই, জিকিরে ফিকিরে চলেন।’ শামিয়ানার তলায় হোগলার পাটি বিছানো। তার ওপর যে যার মতো বিছানা পেতে নিয়েছেন। হাঁড়ি-পাতিল, ব্যাগ, কাঁথা-কম্বল গুটিয়ে সামনে রাখা সারি দিয়ে। অধিকাংশই জিকির-আসকার বা নফল ইবাদতে মগ্ন। অন্যরাও কেউ কারও সঙ্গে তেমন কথাবার্তা বলছেন না। বললেও নিচু স্বরে, যেন অন্যের ইবাদতে ব্যাঘাত না ঘটে। খোলামেলা জায়গায় এত বড় সমাবেশে পিনপতন নীরবতা নামে না। তবু বয়ানের সময় সবাই এত মনোযোগী হয়ে ওঠেন শ্রবণে যে প্রগাঢ় নীরবতা নেমে আসে ময়দানে। সেই নীরবতার মধ্য দিয়ে দূর থেকে মাইকে ভেসে আসা বয়ানের কথাগুলো এক অপার্থিব অনুভূতির সৃষ্টি করে তন্ময় হয়ে থাকা শ্রোতাদের অন্তরে। পরম করুণাময় স্রষ্টার প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা ও ভক্তিতে ভরে ওঠে মন।
গতকাল জুমার আগেই শুরু হয়েছিল দুপুরের খাবার রান্নার পালা। তখন অন্য আরেক পরিবেশ। মাঠের চারপাশের কিনার দিয়ে মাটিতে গর্ত করে তৈরি শত শত চুলায় রান্না হচ্ছে ভাত, খিচুড়ি, বিরিয়ানি, মাছ, গোস্ত, ডাল, সবজি—আরও কত কিছু। রোদঝলমলে দুপুরের হাওয়া তেল-ঝোল-মসলার গন্ধে ম-ম। যশোর শহরের পুলিশ লাইন এলাকার বাসিন্দা আবদুল আজিজ ও নওশাদ আলী এক বিরাট সসপ্যানে সবজি রান্না করছিলেন। তাঁরা জানালেন, ৩৭ জনের একটি দল নিয়ে এসেছেন। এখানে রান্নারও একটি নিয়ম আছে। একেক বেলায় পালা করে চার-পাঁচজন রান্না করেন। খাওয়ার রীতিটাও বেশ আলাদা। কেউ কেউ নিজের থালায় খান। তবে অনেকেই একটি বড় আকারের থালায় একত্রে চারজন করে খেতে বসেন। বাড়ি থেকে শীতের পিঠাপুলি, পায়েস—এসব এনেছেন কেউ কেউ। দেখা গেল, সেই খাবারগুলোও একত্র করে সবাই ভাগাভাগি করে নিচ্ছেন। সবচেয়ে বড় কথা হলো, কারও কোনো অভিযোগ নেই। ব্যবস্থাপনা কিংবা কোনো কিছুর অভাব—এসব নিয়ে তাঁরা অভিযোগ করতে নারাজ। কিশোরগঞ্জের নুরুল হক, আবু বকর সিদ্দিক এমন অনেকের সঙ্গেই কথা বলে জানা গেল, সুবিধা-অসুবিধা কোনো বিষয় নয়। তাঁরা সবাই মনে করেন, আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি লাভের জন্য এখানে এসেছেন। কষ্ট হলেও যদি সেই মকসুদ পূরণ হয়, তাহলেই ইজতেমায় আসা সার্থক। এই আশা নিয়েই তুরাগতীরে এখন অবস্থান করছেন লাখ লাখ পুণ্যার্থী।
দুজনের মৃত্যু: ইজতেমায় অংশ নেওয়া সিরাজগঞ্জের বেলকুচি থানার মধ্য সেতুয়ালী গ্রামের আবদুল মজিদ (৬৫) ও কেরানীগঞ্জের ওমর আলী (৪৮) গত বৃহস্পতিবার রাতে হূদেরাগে আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করেছেন। বাদ জুমা ইজতেমা মাঠেই তাঁদের জানাজা সম্পন্ন হয়।