সেপ্টেম্বর ২০১৩। বলিউড দুনিয়ায় তোলপাড়। বিশ্বখ্যাত রিয়েলিটি শো ‘বিগ বস’-এর উপস্থাপক হিসেবে আবার হাজির সুপারস্টার সালমান খান। সেই উত্তেজনা ফিকে না হতেই ‘বিগ বস’ ঘিরে আবারও হুলস্থুল। ‘বিগ বস’-এর ঘরে আসছেন নতুন এক অতিথি। কিন্তু কে তিনি? ইন্ডিয়া টুডে থেকে এনডিটিভি—সব সংবাদমাধ্যমে খবর আসছে একের পর এক। সম্ভাব্য অতিথি সম্পর্কে পত্রপত্রিকা আর ওয়েবসাইট আভাস দিতে শুরু করেছে, ‘তিনি ভারতের এযাবৎকালের সেরা মডেলদের একজন।’ ‘ভারত তো বটেই, বিশ্বের বহু নামীদামি ফ্যাশন ডিজাইনারের সঙ্গে কাজ করেছেন মুম্বাইয়ের বান্দ্রার বাসিন্দা এই মডেল।’
‘বিশ্বসেরা ফ্যাশন আর লাইফস্টাইল সাময়িকী ভোগ-এর পাতায় তাঁকে দেখা গেছে।’
অবশেষে ঘনিয়ে এল ‘বিগ বস’-এর সেই বিশেষ পর্ব। বলিউডের চেনা মুখ ‘বিগ বস’-এর সব প্রতিযোগী অপেক্ষমাণ।
চোখে উৎকণ্ঠা আর কৌতূহল। সুইমিংপুলের নীল পানি ঘিরে দানা বেঁধেছে রহস্য। ভেজা শরীর। খালি গা। উচ্চতা ঝাড়া ছয় ফুট। সাঁতারের পুকুর থেকে উঠে এলেন সুপার মডেল আসিফ আজিম!
মেনজ হেলথ সাময়িকীর প্রচ্ছদে আসিফ‘বিগ বস’ পরিভাষায় আসিফের ‘ওয়াইল্ড কার্ড এন্ট্রি’ বা ‘বন্য আগমন’ ঘিরে এই উত্তেজনা বহাল থাকুক। চলুন ফিরে যাই বাংলাদেশের এক নিভৃত গ্রামে। মেহেরপুরের সেই গ্রামের নাম আমঝুপি। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়।
সেখানে বেড়ে উঠছে এক দুরন্ত বালক। গ্রামের বাকি আট-দশটা ছেলের মতোই পুকুরে ঝাঁপিয়ে, দিনভর ছুটোছুটি করে দিন কাটে তার। পাঠক, আপনার অনুমান শতভাগ সঠিক। একটু অবিশ্বাস্য হয়তো ঠেকবে। কিন্তু আমাদের আমঝুপি গ্রামের সেই দুরন্ত কিশোরই আজকের সুপার মডেল আসিফ আজিম।
চলচ্চিত্রনগর মুম্বাইয়ে আসিফ আজিমের সাফল্যের খবর কানে আসছিল বহুদিন ধরেই। ‘বিগ বস’ অনুষ্ঠানেও তাঁকে দেখা যাচ্ছিল নিয়মিত। কিন্তু আসিফের নাগাল পাওয়ার উপায় কী? আসিফ আজিমের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে কোনো সাড়া নেই। খবরটা দিলেন নির্মাতা রেদওয়ান রনি। দেশে এসেছেন আসিফ আজিম।
২০ জানুয়ারি রাত প্রায় ১২টা। মাথায় ফ্যাশনেবল ক্যাপ। পরনে ধূসর ট্রাউজার। ধানমন্ডিতে উঠেছেন বোনের বাসায়। সেখান থেকে নিজেই গাড়ি চালিয়ে হাজির গুলশান, পপকর্ন এন্টারটেইনমেন্টের অফিসে। এসেই হাসিমুখে হাত বাড়িয়ে দিলেন:
‘আমি আসিফ।’
শুরুতেই ‘বিগ বস’ টিভি শোতে সেই ‘হট এন্ট্রি’ প্রসঙ্গ। ‘আসলে “বিগ বস”-এ আসার প্রস্তাব আগেও পেয়েছিলাম।’
‘এবার সব ঠিকঠাক মিলে গেছে। আমার আগমনটা বিশেষভাবে হবে—এটা ঠিক করা ছিল। আমার পানিতে নামার খুব ইচ্ছে ছিল না। তারপর ভাবলাম করি, এই আর কী। যে রকম হয়।’ আসিফের জবাব।

আসিফ মেহেরপুর থেকে ঢাকা এসেছিলেন মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে। উঠেছিলেন ঢাকায় বড় ভাইয়ের বাসায়।
ভর্তি পরীক্ষার প্রায় আগে আগেই খুব দুঃখজনক একটা ঘটনা ঘটে। হুট করে মারা যান তাঁর বড় ভাই। সেই দুঃখ সামলে নিয়ে আসিফ পড়ালেখা চালিয়ে যেতে থাকেন। ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে। মডেলিংয়ের দিকে আগ্রহ পরিচিত মানুষজনের কথা থেকেই।
‘সবাই এমনি কথায় কথায় বলত, আমাকে দেখতে মডেলদের মতো লাগে। আমি কেন ট্রাই করি না, এই সব। তো ভাবলাম, একটা ট্রাই করি। সে কারণেই একদিন গিয়েছিলাম ফ্যাশন হাউস আলতামিরার অফিসে। সেখান থেকেই শুরু। সঙ্গে ছবি নিয়ে যেতে হয় তাও জানি না। ওখানে একটা মেয়ে ছিল, তামান্না। ও-ই সব ঠিকঠাক করে দিয়েছিল।’
তারপর মডেলিং শেখা আর কাজের সন্ধানে ঘুরোঘুরি। চোখের সামনে আইকন বলতে ছিলেন বিবি রাসেল। বহু কাঠখড় পুড়িয়ে তাঁর দেখাও পেয়েছিলেন। কিন্তু আজকের সুপার মডেল আসিফ আজিমের সত্যিকার ‘টার্নিং পয়েন্ট’ কোনটা?
`নকশা।’ আসিফের ত্বরিত জবাব।
বটে? এটা কি কোনো রসিকতার অংশ?
সব্যসাচী মুখার্জি, মণীশ মালহোত্রা, রোহিত বাল—এঁরা কেউ নন?
‘মোটেও না। প্রথম আলোর লাইফস্টাইল পেজ নকশাই আমার টার্নিং পয়েন্ট।’ আসিফ রীতিমতো সিরিয়াস।
খুলে বললেন বাকিটা। ‘সম্ভবত ২০০০ সালের গোড়ার দিকে কোনো একটা সময়ে আমার একটা ছবি ছাপা হয়েছিল নকশার প্রথম পাতায়। গায়ে ছিল খয়েরি রঙের পাঞ্জাবি। নকশার প্রথম পাতায় ওই ছবিই আসলে আমাকে প্রথমবারের মতো বড় সুযোগ করে দেয়। এর পরপরই আমি আড়ং, অ্যাকটেল, ক্যাটস আইয়ের মতো দেশীয় বড় ব্র্যান্ডগুলোর মডেল হওয়ার ডাক পাই।’
দুই ‘তা’কে তাঁর ক্যারিয়ারে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন আসিফ। একজন ব্র্যাকের তামারা আবেদ। আরেকজন আলতামিরার তামান্না নামের সেই মেয়ে, যাঁর দেখা আর কখনো পাননি আসিফ।
‘আড়ংয়ের পোশাকের মডেল হিসেবে একটা বিজ্ঞাপনচিত্রের শুটিংয়ে মুম্বাই গিয়েছিলাম। সেবারই প্রথম বিমানে চড়ার অভিজ্ঞতা। সঙ্গী নারী মডেল আমাকে দেখে ঠিক কেন যেন ভরসা পাচ্ছিলেন না। কিন্তু জানতাম, আমি কাজটা পারব। ভালোমতোই পারব।’

‘জীবনের স্বপ্নটা বড় হওয়া চাই’ আসিফ আজিমসেবার শুটিং শেষে মুম্বাইয়ের সৈকতে বেড়াতে গিয়েছিলেন শুটিং ইউনিটের সবাই। সৈকত ধরে গাড়ি ছুটছে।
ঠিক সেই মুহূর্তে আসিফ মনে মনে ঠিক করেছিলেন, এই শহরে তিনি আবার আসবেন। হয়েছেও ঠিক তা-ই।
মুম্বাইয়ে সেই শুটিং দিয়ে শুরু। এখন আসিফের জীবনের বড় একটা সময় কাটে বিমানে। পৃথিবীর এমাথা-ওমাথা চষে বেড়িয়ে। কখনো স্পেন, কখনো সিডনি, কখনো ইন্দোনেশিয়ার বালি, কুয়ালালামপুর, দুবাই। সর্বভারতের ‘ফিটেস্ট মেল মডেল’দের তালিকায় তাঁর অবস্থান এখন চার। মোটামুটি দম ফেলার ফুরসত নেই। নয় কি দশ বছর হয়ে গেল মুম্বাইয়ে আবাস গড়েছেন আসিফ।
ভারতের বেঙ্গালুরু থেকে মুম্বাই-জয়ের অভিযান শুরু আসিফের। ২০০৬ সালে হেমেন ত্রিবেদীর একটি ফ্যাশন শো দিয়ে প্রথম সবার নজরে আসেন আসিফ। একই বছরে সাড়া ফেলে দেয় তাঁর করা মটোরোলা ফোনের বিজ্ঞাপনচিত্র। এখন তাঁর ঝুলিতে জমা হয়েছে ভারতের প্রথম সারির সব ডিজাইনারের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা। কদিন আগেও মুম্বাইয়ের আরেক নামী র‌্যাম্প মডেল ক্যান্ডিস পিন্টোর সঙ্গে তাঁর প্রেম নিয়ে বেশ সরব ছিল বলিউড মিডিয়া। আসিফের চোখ এখন বলিউডের বড় পর্দায়। ভারতের কয়েকটা পত্রিকায় এরই মধ্যে খবর বেরিয়েছে, বলিউডের সিনেমা-জগতে পা রাখতে চলেছেন সুপার মডেল আসিফ আজিম। আর আসিফ কী বলেন?
‘এখনই কিছু বলতে চাই না। তবে আশা করছি। খুব দ্রুত একটা ভালো খবর দিতে পারব।’

আলাপ-পর্ব ফুরোতে গভীর রাত। আসিফ উঠেছেন ঢাকায় তাঁর বোনের বাসায়। এত রাতে একা গাড়ি চালিয়ে যাবেন। তাই তাঁকে সঙ্গ দিতে যাচ্ছি ধানমন্ডি অবধি। আসিফ পেছনের আসনে।
তাঁকে একটা প্রশ্ন না করে পারি না। আসিফ আজিম হওয়ার মূলমন্ত্রটা কী? জবাব সম্ভবত তৈরিই ছিল, ‘স্বপ্ন। স্বপ্নটা বড় হওয়া চাই। কে না জানে একটা ঢিল দশতলা লক্ষ্য করে ছুড়লে সেটা কেবল দশতলা অবধিই পৌঁছাবে। আর আকাশের দিকে ছুড়লে সেটার সম্ভাবনা অসীম। স্বপ্নের সঙ্গে চাই সততাও। ‘বিগ বস’ আমার জীবনের ছোট একটা অংশ মাত্র। হার-জিতের চেয়েও আমি সবার আগে ভেবেছি, সবাই যেন আমার শিকড় সম্পর্কে খারাপ কিছু না ভাবে। এই শোতে অনেক ধরনের বাজে পরিস্থিতির মধ্যে আমি পড়েছি। এমন হয়েছে, গরম পানিতে গোসল করছি, হঠাৎ বরফঠান্ডা পানি গায়ে এসে পড়ল। বিগ বসের ঘরে প্রায় দিনই খাবার পেতাম না। অন্যরা খাবার লুকিয়ে রাখত। কিন্তু আমি সব সময় মাথা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করেছি। নিজেকে বুঝিয়েছি। জীবনে অনেক কষ্ট সয়েছি, এই কষ্টও সইতে পারব। আমার দেশ বাংলাদেশ। বাংলাদেশিরা বড়দের সম্মান করে। আর শত অভাব-সংকটের মুখেও নিজের সম্মান বিসর্জন দেয় না।’


সালমান খানের সঙ্গে আবেগময় মুহূর্ত: বিগ বস থেকে বিদায় নেওয়ার দিনে আসিফ আজিমসালমানের সঙ্গে

বিশ্বখ্যাত টিভি রিয়েলিটি শো ‘বিগ ব্রাদার’-এর ভারতীয় সংস্করণ ‘বিগ বস’। এই টিভি শোতে প্রতিযোগীরা বিশেষ একটি ঘরে বাস করেন। তাঁদের সঙ্গে বাইরের দুনিয়ার যোগাযোগ থাকে না বললেই চলে। প্রতিযোগীদের প্রায় সার্বক্ষণিক ক্যামেরায় ধারণ করা হয়। ‘বিগ বস’ থেকে আসিফ আজিমের বিদায় নেওয়ার ঘটনাতেও বড় ধরনের হুলস্থুল ছিল বলিউড মিডিয়ায়। আগের সপ্তাহে সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়েও পরের দফায় আসিফের অপ্রত্যাশিত বিদায় মেনে নিতে পারছিলেন না অনেকেই। ‘বিগ বস’-এর ঘরে সালমানের প্রিয় পোষা কুকুরের সঙ্গে আসিফের সখ্য ছিল মুম্বাইয়ে ‘টক অব দ্য টাউন’। শোয়ের উপস্থাপক সালমান খান জড়িয়ে ধরেছিলেন বিদায়ী আসিফকে। সালমানের সেই ভ্রাতৃসুলভ আলিঙ্গন বানোয়াট কিছু ছিল না। প্রমাণ মিলল কদিন পরেই। সালমান খান তাঁর জন্মদিনের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন আসিফ আজিমকে। পুনের কাছাকাছি একটা জায়গায় সালমান খানের সুবিশাল খামারবাড়িতে ছিল জন্মদিনের উৎসব।
সেদিন প্রথম কথাটা কী ছিল সালমানের?
‘হিন্দি শেখা কেমন চলছে? এটাই ছিল সালমানের প্রথম কথা।’ বলছিলেন আসিফ। তাঁর ভাষায়, ‘হিন্দি শেখা খুব কঠিন। ইংরেজিতে কথা বলতে পারলে “বিগ বস”-এ আরও বেশি সুবিধা হতো আমার জন্য।’